এই দেশে কাঁচামালের অভাব নেই। এদেশের কোনো শিল্প-কারখানা কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়নি। বরং, --এদেশের কাঁচা-রাবার, কাঁচা-চামড়া কাঁচা অবস্থাতেই নগণ্য মূল্যে পূর্বে-পশ্চিমে রপ্তানি হয়েছে এবং হ’চ্ছে। অথচ ওগুলোরই প্রক্রিয়াজাত প্রস্তুতপণ্য আমদানি করতে করতে এদেশটি সংকটজনকভাবে ঋণাক্রান্ত।

(ঋণগ্রস্ততা এবং অভাবগ্রস্ততা সমার্থক নয়। তবুও মুষ্টিমেয় যে ক’জন ‘বিদেশি-ত্রাণ’খোর চিহ্নিত ভিখারি বলে,-‘এদেশ দরিদ্র দেশ,’-সম্ভবত তারা এ উদ্দেশ্যেই বলে যাতে বিদেশি ত্রাণ বা সাহায্য টেনে এনে দলীয় পোষ্যপুত্রদেরকে ছিটেফোঁটা ছিটিয়ে অবশিষ্ট সিংহভাগ দিয়ে নিজেদের ঝুলি ভরানো যায়।)

এদেশের মাটিতে ফলের এবং ফসলের এতই ফলন যে, -রপ্তানি না-করলে ওগুলো পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়ায় তাই জনগণ বাধ্য হয়েই উর্বর জমি আবাদ না-ক’রে ফেলে রাখে। রপ্তানির লক্ষ্যে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য যেটুকু কারিগরি সহযোগিতা আবশ্যক তারচে’ বহু বহুগুণ প্রযুক্তি হেলায় খেলায় এদেশের পথে-ঘাটে বিলাস-ব্যবহারে অপচয়ে-অপকর্মে ক্ষয় হয়। এদেশে জ্বালানি-জড়শক্তি-জৈবশক্তির পরিমাণ যথেষ্টর চেয়েও বেশি। তারও চেয়ে বেশি আছে এখানে জনশক্তি। এদেশে অভাব নেই। এদেশকে দরিদ্র দেশ ব’লে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা ঘৃণ্য অপরাধ।

পৈত্রিক বাস্তু বন্ধক রেখে কিম্বা কোনো হিতাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতায় কিম্বা লটারিতে সুযোগ পেয়ে কিম্বা অবৈধ চোরাপথে এদেশ থেকে যেসব জনশক্তি পূর্বের কিম্বা পশ্চিমের দেশগুলোতে গিয়ে মূল্যের বিনিময়ে শ্রম দিচ্ছে অথবা শিক্ষালাভ করছে, -কেউই অদক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হ’চ্ছে না। বরং, এদেশের দ্বিতীয় সারির একজন শিক্ষার্থী অথবা যেকোনো ধরণের শ্রমজীবী বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রথম সারির দক্ষতমদের সমতুল্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতর প্রমাণিত হয়েছে।
(সর্বশেষ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন দ্রষ্টব্য :)

মাটিকে ভাঁটায় পোড়ানো হ’লে ইটে পরিণত হয়। গুণগতমান সম্পন্ন ইটকে কাজে না-লাগিয়ে যদি আরও পোড়ানো হয় তাহলে ফলাফলে ঐ ইট মান হারিয়ে ‘ঝামা’ বা ‘পিকেট’ হ’য়ে যায়। একই বিধানের নীতিতে মানসম্পন্ন জনগণের অর্থাৎ দক্ষ জনশক্তির গুণ বাড়ানোর বুলিসর্বস্ব প্রস্তাবকে শয়তানি বক্তব্য মনে করার বৈধ অধিকার আছে এদেশের জনগণের।
এদেশের জনসংখ্যাকে ‘অদক্ষ জনশক্তি’ বলবার আগে আবারও একবার ভেবে দেখবার অবকাশ দেওয়া হ’চ্ছে।

নিজেরাই অদক্ষ এবং অভিজাত ভিখারি হিসেবে চিহ্নিত কিছুসংখ্যক নকল মালিক নিজেদের ঘৃণ্য অস্তিত্বের স্বার্থে পোষ্যপুত্র বানিয়ে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, বেকার, ভবঘুরে ইত্যাদি ইত্যাদি পরিচয়ে, -যাদেরকে পরিচিত রাখতে চায়,-তারাও কর্মসংস্থান সমৃদ্ধ দেশগুলোতে গেলে পরে সসম্মানে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে।
তবুও শোনা যায় সভায়-জলসায়-সমাবেশে-অধিবেশনে অশ্লীল বক্তব্য যেমন, --এদেশ দরিদ্র, এদেশের জনগণকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে, --ইত্যাদি ইত্যাদি।
( মালয়ভাষী স্বনামধন্য মাহাথির মোহাম্মদের শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলায় কথা বলতে না-পারাকেও অদক্ষতা হিসেবে গণ্য করতে চায় এদেশের ঐ চিহ্নিত ভিখারিরা। )

এদেশের জনশক্তিকে দক্ষ জনশক্তি বলতেই হবে।
যে-কেউ বলবে এদেশ দরিদ্র, তার গালে কষে থাপ্পড় মেরে তার কানটা ধ’রে হিড়হিড় ক’রে টেনে নিয়ে গিয়ে বস্তির ডাষ্টবিনটার ময়লা আবর্জনায় নাকটা ঘ’ষে দিন,--তাতে সামান্য জেল-জরিমানা হ’তে পারে তা যেমন সত্যি, তার চেয়েও বড় সত্যি, আপনার ঐ সৎসাহসী কর্মটির জন্য আপনার উত্তরসূরিরা আগামীতে আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

---রঙ্গপুর